স্কাই টাওয়ার (অকল্যান্ড)

প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে, বড় কোনো মহাদেশ থেকে বহু দূরে, ওশেনিয়া অঞ্চলে নিউজিল্যান্ডের মূলত দুটি বড় দ্বীপ অবস্থিত—যা নর্থ ও সাউথ আইল্যান্ড নামে পরিচিত—এবং এখানে প্রায় ৭০০টি ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৭৭% (প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন) নর্থ আইল্যান্ডে বাস করে, যেখানে সাউথ আইল্যান্ডে মাত্র ১.২ মিলিয়ন মানুষের বসবাস করে। নর্থ আইল্যান্ডে রয়েছে উষ্ণ প্রস্রবণ, মনোমুগ্ধকর সৈকত, আগ্নেয়গিরির ভূমিচিত্র এবং গভীরভাবে প্রোথিত মাওরি সংস্কৃতি। এর কেন্দ্রবিন্দু অকল্যান্ড—যা একটি ব্যস্ত ও বহুজাতিক মহানগরী—যেখানে নিউজিল্যান্ডের সামাজিক বৈচিত্র্য অনুভব করা যায়। শহরটির কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত স্কাই টাওয়ারে উঠে পর্যটকরা নিউজিল্যান্ডের অপূর্ব দৃশ্যপট উপভোগ করতে পারে। ৩২৮ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন এই টাওয়ারটি দক্ষিণ গোলার্ধের সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা এবং এখান থেকে পাওয়া যায় শ্বাসরুদ্ধকর প্যানোরামিক ভিউ উপভোগ করা যায়।

অকল্যান্ড ওয়ার মেমোরিয়াল মিউজিয়াম (অকল্যান্ড)

নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস এবং মাওরি সংস্কৃতি জানতে চাইলে অকল্যান্ড ওয়ার মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অবশ্যই দেখতে হবে। ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘরটি দেশটির অন্যতম প্রাচীন জাদুঘর। এর মূল প্রদর্শনীগুলোতে স্থান পেয়েছে মাওরি ঐতিহ্য এবং প্রধান দুটি দ্বীপের উদ্ভিদ ও প্রাণী বৈচিত্র্য। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও অন্যান্য বৈশ্বিক সংঘর্ষে নিউজিল্যান্ডের অংশগ্রহণ নিয়েও বিশদ তথ্য রয়েছে। জাদুঘরটিতে মাওরি শিল্পকর্মের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে—যেমন যুদ্ধে ব্যবহৃত নৌকা (ওয়াকা তাওয়া), আনুষ্ঠানিক সামগ্রী, অস্ত্র, বল্লম ও লাঠি।

ওয়াইপোয়া ফরেস্ট (কেপ রেইঙ্গা)

নর্থ আইল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে ও কেপ রেইঙ্গার দক্ষিণে প্রাচীন ওয়াইপোয়া ফরেস্ট অবস্থিত। এটি একটি সংরক্ষিত অঞ্চল যেখানে পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবন্ত গাছের মধ্যে অন্যতম, ‘কাউরি’ গাছের রয়েছে। এই চিরহরিৎ দৈত্যাকার গাছ নিউজিল্যান্ডের নিজস্ব উদ্ভিদ এবং প্রায় ৫০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে, ব্যাসের দিকে থেকে এটি ৫ মিটার এবং গাছটির আয়ু ২০০০ বছর বা তারও বেশি হতে পারে। এই গাছগুলোর শিকড় ভূমিক্ষয় রোধ করে এবং বনভূমির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। ঘন ছায়াযুক্ত ছাউনির নিচে গড়ে উঠেছে এক অনন্য বাস্তুতন্ত্র—যেখানে দেখা যায় ফার্ন, শৈবাল, অর্কিড, এপিফাইট ও রিমু গাছ। আর এসব শিকড়ের ফাঁকে দেখা মিলতে পারে নিশাচর ও উড়তে অক্ষম কাকাপো এবং কিউই পাখির।

ওয়াইটোমো গুহা (হ্যামিলটন)

হ্যামিলটনের দক্ষিণে, টে কুইটি থেকে মাত্র ১৭ মিনিট দূরে অবস্থিত ওয়াইটোমো লিমেস্টোন গুহাসমূহ, যা জ্বলে ওঠা কীটের (গ্লোওয়ার্ম) জন্য বিখ্যাত। এদের আলোয় গুহার ছাদ তারাভরা আকাশের মতো ঝলমল করে। এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যুর হলো একটি নৌকাভ্রমণ, যা গুহার নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর ওপর দিয়ে এই আলোঘেরা জগতে নিয়ে যায়। প্রায় ৩০ মিলিয়ন বছর আগে টেকটোনিক পরিবর্তনের ফলে তৈরি এই গুহাগুলোর পাথর ছিল একসময় সমুদ্রতল থেকে উঠে আসা চুনাপাথর। পানির ফোঁটা ফোঁটা চাপে তৈরি হয়েছে স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট, অনেক জায়গায় এক হয়ে তৈরি করেছে খাড়া স্তম্ভ। এই প্রাকৃতিক গঠন এবং আলোর খেলা গুহাকে দেয় এক জাদুকরী, প্রায় অতিপ্রাকৃত আবহ।

তোঙ্গারিরো ন্যাশনাল পার্ক (উত্তর দ্বীপ)

তোঙ্গারিরো ন্যাশনাল পার্ক নর্থ আইল্যান্ডের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং এটি ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। এর অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে আগ্নেয়গিরিভিত্তিক প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং স্ফটিকস্বচ্ছ নীল হ্রদ। এখানেই রয়েছে দ্বীপটির সর্বোচ্চ পর্বত—মাউন্ট রুয়াপেহু (২,৭৯৭ মিটার)—এবং একটি আগ্নেয়গিরির গর্তে থাকা উজ্জ্বল ফিরোজা রঙের হ্রদ, যার উষ্ণতা নির্ভর করে ভূ-তাপীয় সক্রিয়তার ওপর। ট্রেকারদের জন্য এটি স্বর্গতুল্য স্থান, বিশেষ করে যারা বিশ্বসেরা একদিনের হাইকিং ট্রেইল—তোঙ্গারিরো আলপাইন ক্রসিং—ভ্রমণ করতে চান। ১৯ কিমি দীর্ঘ এই ট্রেইল শুরু হয় মাঙ্গাটেপোপো উপত্যকা থেকে, পেরোয় মাউন্ট নাউরুহোয়ি, বিশাল আগ্নেয় মালভূমি, এমারেল্ড লেক ও ব্লু লেকের পাশ দিয়ে। ট্রেইলের শুরু ও শেষ পয়েন্টে শাটল বাস সার্ভিসও রয়েছে।

লেক টেকাপো (দক্ষিণ দ্বীপ)

নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ড বুনো সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত— যা সুউচ্চ পর্বতমালা, হিমবাহ এবং দর্শনীয় ফিয়র্ডে ভরপুর। এই দ্বীপের অন্যতম আকর্ষণ হলো হিমবাহঘেরা লেক টেকাপো, যা সাউদার্ন আল্পসের পাদদেশে অবস্থিত। এই অপূর্ব ফিরোজা রঙ “গ্লেসিয়াল ফ্লাওয়ার”-এর কারণে ধারণ করেছে, যা গলে যাওয়া হিমবাহ থেকে আসা সূক্ষ্ম খনিজ কণার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। সূর্য আলো পড়লে এই হ্রদ যেন জেগে ওঠে স্বপ্নময় রঙে। গ্রীষ্মের শুরুতে হ্রদের পাড় জুড়ে ফোটে হাজারো লুপিন ফুল। লেক টেকাপো প্রকৃতি ও প্রশান্তির খোঁজে থাকা ব্যক্তির জন্য আদর্শ আশ্রয়। হ্রদের পাশে অবস্থিত ছোট্ট চার্চ অফ দ্য গুড শেপার্ড যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশে যায় অনায়াসেই। আশপাশের হাইকিং ও সাইক্লিং ট্রেইলগুলো প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।